হাসপাতালে গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ:গেজেটে আছে,বাস্তবে নেই!

হাসপাতালে গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ
আড়াই বছর আগের কথা । ২০১৮ সালের ২৪ শে মার্চ । সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের নন-ক্যাডার পোস্টে নবম গ্রেডে দেড় হাজার গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগের গেজেট প্রকাশিত হয় । স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন মানুষ এই ভেবে উচ্ছ্বাসিত হলো এবার তাহলে কিছুটা পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে । প্রেসক্রিপশন কিংবা ওষুধের ডোজ নির্ধারণের বিষয়গুলো তাহলে এখন থেকে ওষুধবিজ্ঞানীদের দ্বারা পুনঃনিরীক্ষণ করা হবে । স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন হবে । কিন্তু আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও হাসপাতালে গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ হয় নি !

বিশ্বের প্রতিটি দেশের স্বাস্থ্যখাত পরিচালিত হয় ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট এবং নার্স এই তিনটি পেশার লোক নিয়ে । যেখানে ডাক্তার রোগ নির্ণয়ে বিশেষজ্ঞ, ফার্মাসিস্ট ওষুধ বিশেষজ্ঞ এবং নার্স পেসেন্ট কেয়ারিং এ বিশেষজ্ঞ । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এদের যে কোন একটা ব্যতীত উন্নত স্বাস্থ্যসেবা সম্ভব নয় । এমনকি আমাদের দেশের নামকরা প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতেও আছে ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট এবং নার্স । কিন্তু গেজেট প্রকাশের আড়াই বছরেও সরকারি হাসপাতালগুলোতে নিয়োগ হয়নি গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট !

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ২,৫০০ মানুষের বিপরীতে একজন করে ডাক্তার আছে । যা নিতান্তই অপ্রতুল । আর আমাদের দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে একজন ডাক্তারকে যে পরিমাণ রোগী দেখতে হয় তা বিশ্বের অন্য কোথাও হয় না । বিপুলসংখ্যক রোগীর রোগ নির্ণয়ের পাশাপাশি মেডিসিন প্রেসক্রাইব করতে গিয়ে ভুল হওয়া স্বাভাবিক । কিন্তু হাসপাতালে গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট না থাকায় এই প্রেসক্রিপশনের ত্রুটি ধরা সম্ভব হচ্ছে না । পাশাপাশি ঔষধের ডোজ নির্ধারণ এবং একাধিক ঔষধের ক্ষেত্রে ড্রাগ-ড্রাগ ইন্টারেকশন বিষয়ে একজন ডাক্তারের চেয়ে একজন ফার্মাসিস্ট অনেক বেশি পড়ালেখা করে । সুতরাং এই সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে তারাই সূক্ষ্ম সিদ্ধান্ত দিতে পারবে ।

রাজশাহীর একটি সরকারি হাসপাতালে ২০০ জন ইনপেশেন্ট রোগীর প্রেসক্রিপশন নিয়ে একটা রিসার্চ করা হয়েছিল । যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ ফার্মেসিউটিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে । সেখানে দেখা যায় প্রেসক্রাইব করা ৫৩.১৯% ঔষধের ড্রাগ-ড্রাগ ইন্টারেকশন আছে । এতে করে বিভিন্ন মেডিসিনের ডোজ এডজাস্ট করার প্রয়োজন ছিলো যা করা হয়নি । আর এই কাজটি করার জন্য দরকার ছিলো একজন দক্ষ ফার্মাসিস্ট । হাসপাতালে গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ হলে এই কাজগুলো তারাই করতো । এতে করে যেমন ডাক্তারদের উপর চাপ কমতো, তেমনিভাবে দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানও উন্নত হতো ।

আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের পক্ষে ঔষধের পিছনে যথেষ্ট অর্থ খরচ করা সম্ভব নয় । কাজেই কম খরচে ঔষধের সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত । এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে ফার্মাসিস্টরা । হাসপাতালে গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দিলে তারা রোগীর আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে বিকল্প ঔষধের পরামর্শ দিতে পারে । এতে করে জনগণ উপকৃত হবে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়বে ।

আমাদের দেশের অসচেতন মানুষদের মাঝে একটা মিথ প্রচলিত আছে, "স্বাস্থ্যখাত মানে শুধুই ডাক্তার ।" আর গেজেট প্রকাশের আড়াই বছরেও হাসপাতালে গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ না হওয়া প্রমাণ করে আমাদের স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্টরাও হয়তো এই মিথ থেকে বের হতে পারে নি কিংবা তারা ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়োগে অবহেলা করছে । যার ফলস্বরূপ জনগণ তাদের প্রাপ্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । এমনকি হাসপাতালে ১:৩ অনুপাতে ডাক্তার এবং নার্স থাকার কথা থাকলেও বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে এখনো ডাক্তারের চেয়ে নার্সের সংখ্যা কম! তাছাড়া নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না পর্যাপ্ত ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্ট এবং টেকনোলজিস্ট । তাই এক্ষেত্রে সমন্বয়টা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

গত এক দশকে অর্থনৈতিকভাবে দেশ এগিয়েছে বহুদূর । অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন অনেক ভালো অবস্থানে আছে । আমরা স্বাস্থ্যখাতেও পিছিয়ে থাকতে চাই না । উন্নত দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও এগিয়ে যেতে চাই স্বাস্থ্যসেবায় । যাতে করে উন্নত স্বাস্থ্যসেবার জন্য আমাদের অন্য কোনো দেশে চিকিৎসার জন্য যেতে না হয় । আমাদের সকলের আস্থার প্রতীক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার অনুরোধ থাকবে দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে, সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে গেজেটে প্রকাশিত দেড় হাজার গ্রাজুয়েট ফার্মাসিস্ট যেনো অচিরেই নিয়োগ দেওয়া হয় ।

লেখক:
Md Jahid Hassan
মো.জাহিদ হাসান
শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

Post a Comment

0 Comments